গ্রামে যাচ্ছে ডিজিটাল সেন্টার, স্মার্ট হচ্ছে সেবা
ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার প্রতিষ্ঠার ফলে গ্রামের হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এখন তাদের দক্ষ করতে প্রথিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। অপর বক্তৃকায় স্মার্ট বাংলাদেশের রূপরেখা তুলে ধরে তিনি বলেছেন, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে আমাদের জনগণ হবে ই-পপ্যুলেশন, ই-জনগোষ্ঠী। আমাদের প্রশাসন ই-প্রশাসন, জ্যুডিশিয়ারি তথ্যপ্রযুক্তি সম্পন্ন ইজ্যুডিশিয়ারি। আমাদের অর্থনীতি ই-ইকোনমি, ই-এড্যুকেশন, ই-হেলথ। এভাবেই আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে একটি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলবো।
এর আগে ২০১০ সালের ১১ নভেম্বর সারা দেশের সাড়ে ৪ হাজার ইউনিয়নে একযোগে ‘ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্র’ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সময়ের ধারাবাহিকতায় সেটির নাম ‘ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার’ হিসাবে পরিবর্তিত হয়। নগর ও প্রবাসে একই মডেলের সেন্টার করার ধারাবাহিকতায় এখন তা কেবল ‘ডিজিটাল সেন্টার’ হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি সেবা জনগণের আরও কাছে নিয়ে যেতে এই কেন্দ্র এখন পৌঁছে দেয়া হবে দেশের প্রতিটি গ্রামে। এর সেবাগুলো হচ্ছে স্মার্ট।
এ নিয়ে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেছেন, “দেশের ৮৭ হাজার গ্রামে একটি করে ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করা হবে, যাতে প্রতি ৫ কিলোমিটারের পরিবর্তে প্রতি ২ কিলোমিটারের মধ্যে একটি করে ডিজিটাল সেন্টার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের হাতের নাগালে সকল সেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়।”
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এবং প্রবাসে বর্তমানে ৮ হাজার ৮০৫টি ডিজিটাল সেন্টার রয়েছে। প্রবাসে ডিজিটাল সেন্টারের সংখ্যা এখন ১৫টি। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত ডিজিটাল সেন্টার মডেলটি ভবিষ্যতে বিদেশের মাটিতে প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে এটুআই’র পলিসি অ্যাডভাইজার আনীর চৌধুরী বলেছেন, সারাদেশের ডিজিটাল সেন্টারগুলোকে দেশের সব উপজেলার কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) শিল্প হাব হিসেবে তৈরি করতে আমরা ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছি। আগামী তিন বছরের মধ্যে জাতিসংঘের সহায়তায় এর অধিভুক্ত ১৭০টি সদস্য দেশের মধ্যে অন্তত ৫০টি দেশে বাংলাদেশের ডিজিটাল সেন্টারের মডেলটি প্রতিস্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।”
এসব উদ্যোগের পাশাপাশি তৃণমূলে নানা কারণে ঝরে পড়া নারী উদ্যোক্তাদের দীর্ঘ মেয়াদে ধরে রাখতে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণের আহ্বান সংশ্লিষ্টদের। ই-ক্যাব প্রেসিডেন্ট শমী কায়সার- বাইট “নারী উদ্যোক্তাদের দীর্ঘ মেয়াদে ধরে রাখতে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।”
ডিজিটাল সেবা কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের এগিয়ে নিতে কাজ করছে সরকার। লক্ষ্যপূরণে ২০৪১ সাল নাগাদ সবার জন্য স্মার্ট সেবা’ বাস্তবায়ন করছে এটুআই। ইউএনডিপি’র সহায়তায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের আওতায় বাস্তবায়ন হচ্ছে ‘এটুআই’ কর্মসূচি। এটু্আইকে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় রূপ দিতে ইতোমধ্যে আইনের খসড়া অনুমোদন দিয়েছে সরকার।
আইসিটি প্রতিমন্ত্রী পলক জানান, “ইন-লাইনের সেবা অনলাইনে, শহরের সেবা গ্রামে এবং দেশের সেবা বিদেশে নিয়ে যেতে কাজ করেছে ডিজিটাল সেন্টার। তরুণদেরকে কেবল ‘চাকরি প্রত্যাশী’ হিসাবে না রেখে ‘চাকরিদাতা’ হিসাবে প্রতিষ্ঠার কাজটি ডিজিটাল সেন্টার করতে পেরেছে।”
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এবং প্রবাসে বর্তমানে ৮ হাজার ৮০৫টি ডিজিটাল সেন্টার রয়েছে। প্রবাসে ডিজিটাল সেন্টারের সংখ্যা ১৫টি।
“এসব সেন্টারের ১৬ হাজারের বেশি উদ্যোক্তা রয়েছেন। প্রতিমাসে গড়ে ৭০ লাখেরও অধিক সেবা দিচ্ছে। সেবার তালিকায় সব মিলিয়ে তিন শতাধিক সরকারি-বেসরকারি সেবা রয়েছে।নারী-পুরুষের মধ্যে অংশীদারিত্বমূলক পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে প্রতিটি ডিজিটাল সেন্টারকে গ্রামীণ অর্থনৈতিক হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠায় উদ্যোক্তারা যেন কাজ করতে পারেন, সেজন্য আমাদের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে”-যোগ করেন এটুআই প্রকল্প পরিচালক দেওয়ান মুহাম্মাদ হুমায়ুন।
সূত্রমতে, দেশের ডিজিটাল সেন্টারের ১৬ হাজারের বেশি উদ্যোক্তা রয়েছেন। প্রতিমাসে গড়ে ৭০ লাখেরও অধিক সেবা দিচ্ছে। সেবার তালিকায় সব মিলিয়ে তিন শতাধিক সরকারি-বেসরকারি সেবা রয়েছে।
নাগরিকের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে ডিজিটাল সেন্টার একটি সফল রোল মডেল হিসেবে বৈশ্বিকভাবেভাবে স্বীকৃত। দেশব্যাপী ৮,৮০৫টি ডিজিটাল সেন্টারে পুরুষ ও নারী উদ্যোক্তা সমন্বিতভাবে বিগত ১ যুগ ধরে সরকারি-বেসরকারি সকল সেবা সহজে দ্রুত ও স্বল্প ব্যয়ে নাগরিকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে। এসব সেন্টার থেকে প্রতিমাসে গড়ে ৭০ লাখেরও অধিক সেবা প্রদান করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তারা ইতোমধ্যে নাগরিকদের প্রায় ৮০.২৮ কোটিরও অধিক সেবা প্রদান করেছেন। যার ফলে নাগরিকদের ৭৮.১৪% কর্মঘণ্টা, ১৬.৫৫% ব্যয় এবং ১৭.৪% যাতায়াত সাশ্রয় করা সম্ভব হয়েছে।
ই-নথি ছাড়াও জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩, ই-নামজারি, আই-ল্যাব, ভার্চুয়াল কোর্ট সিস্টেম, ডিজিটাল ক্লাসরুম ও ‘বিনিময়’ এর মতো স্মার্ট সেবার পাশাপাশি ই-কমার্স খাতে যুক্ত হয়েছে ‘ডিজিবক্স’। ডিজিটাল সেবাগুলো হচ্ছে স্মার্ট। এক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেন ডিজিটালাইজেশনে বড় ভূমিকা রাখছে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস)। এ বছর এমএফএস অ্যাকাউন্টধারীর সংখ্যাও ১৮ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমানে বিকাশ, রকেট, নগদসহ ১৩টি এমএফএস অপারেটরের মাধ্যমে দৈনিক প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে।
এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বিনিময় প্লাটফর্ম উদ্বোধান করেন প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ। তিনি বলেছেন, ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারণা, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন আমাদের নিজেদের, হয়তো কিছু কিছু প্রোজেক্ট বাস্তবায়নে বিদেশি কোম্পানি কাজ করেছে কিন্তু পুরো পরিকল্পনা, ডিজাইন হয়েছে বাংলাদেশের নিজস্ব সক্ষমতায়। আমার পরবর্তী লক্ষ্য ক্যাশলেস সোসাইটি গড়ে তোলা। গামী ২-৩ বছরেই হয়তো সব সরকারি সেবাও ডিজিটাইজড হয়ে যাবে।
আইসিটি বিভাগ সূত্র জানাচ্ছে, ১৮ বছর আগে ডিজিটাল অর্থনীতির আকার ছিল মাত্র ২৬ মিলিয়ন ডলার। বর্তমানে তা ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। সরকারের লক্ষ্য, ২০২৫ সাল নাগাদ আইসিটি রপ্তানি ৫ বিলিয়ন ডলার এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির মাধ্যমে আইসিটি খাতে কর্মসংস্থান ৩০ লাখে উন্নীত করা হবে। ১০৯টি হাই-টেক, আইটি পার্কে বা শেখ কামাল আইটি ইনকিউবেশন সেন্টারের (১৭টি বেসরকারি আইটি পার্ক) মধ্যে নির্মিত ১০টি পার্কে দেশি-বিদেশি ১৯২টি প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করেছে। বিনিয়োগ হয়েছে দেড় হাজার কোটি টাকা।
আর এর প্রতিটি কাজের বাহন হয়েছে ইন্টারনেট ও ডিজিটাল ডিভাইস। এ বছরই ইন্টারনেট গ্রাহক সাড়ে ১২ কোটির মাইলফলক ছাড়িয়ে গেছে। সিম নিবন্ধনের হিসাবে সেলফোন ব্যবহারকারী ১৮ কোটি ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সর্বশেষ হিসাবে, দেশে বর্তমানে ইন্টারনেট গ্রাহক ১২ কোটি ৬১ লাখ, যার মধ্যে ১১ কোটি ৬৬ লাখই টেলিকম অপারেটরনির্ভর ব্যবহারকারী। ইন্টারনেটের যে ব্যবহারকারীর হিসাব রয়েছে, সেখানে ব্রডব্যান্ড ব্যবহারকারীও অনেক কম। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের গতি ও সেবায় এখনও পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। তবে এই অবস্থার উত্তরণে এ বছরেই ‘এক দেশ এক রেট সেবা’ বাস্তবায়নে বৈশ্বিক সম্মাননা জিতে নিয়েছে বিটিআরসি।
এ নিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, একদেশ এক রেট বাস্তবায়নে আমি আইএসপি’দের কাছে কৃতজ্ঞ। এখন অনেকে এক দামের চেয়েও কম দামে ইন্টারনেট দিচ্ছে।
এদিকি বিদায়ী বছর থেকেই দেশেই তৈরি হচ্ছে স্মার্ট গাড়ি। এ বছরই প্রথম ইলেকট্রিক বাইকের নিবন্ধন দিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। নিবন্ধন পেয়েছে ওয়ালটন ইলেকট্রিক বাইক ‘তাকিওন’। দেশেই ব্যাটারিচালিত প্রাইভেটকার তৈরি করে আলোচনায় এসেছে দেশীয় নতুন দুই প্রতিষ্ঠান বাঘ ইকো মোটরস ও পালকি মোটরস। বিশ্বে নানা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে লাল-সবুজের পতাকাকে সমুন্বত করছে তরুণেরা। ৩য়বারের মতো বিশ্বের ১৬২টি দেশের ৫৩২৭টি দলকে হারিয়ে নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জ’২২ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের খেতাব অর্জন করেছে বাংলাদেশ। দেশজুড়ে শুরু হয়েছে স্টার্টআপ কম্পাস। স্টার্টআপ সংস্কৃতির বিকাশ এবং স্টার্টআপদের উদ্ভাবনী সুযোগ কাজে লাগাতে আগামী পাঁচ বছরে ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে আইসিটি বিভাগের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান ‘স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড’। চলতি বছরে বিনিয়োগ করেছে ৫৩ কোটি টাকার বেশি।