কবে খুলবে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান!
বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নাকি সাউথ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে লং টার্মে বন্ধ, অফলাইন অনলাইন উভয় মাধ্যমেই। কোনো ডেটা নাই, শোনা কথা। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম দিকে ওয়েট করলেও এখন তারা ভালোভাবেই পড়িয়ে পাবলিককে ছাড়ায় গেছে (প্রায় এক বছর সিনিয়র তারা)। যদিও আমাকে পাবলিকের স্টুডেন্ট হিসেবে কিছু কনসিকোয়েন্স ফেস করতে হতে পারে বা হবে, কিন্তু আমি খুশি। আমি আমার এক স্টুডেন্টরে ২০২০ এ ইন্টারে পড়ানোর সময় বলছিলাম, প্রাইভেট ইউনিগুলা আগায়ে যাবে সবদিক থেকে। একটা সময় আসবে যখন বাপ-মা লাস্ট চান্স হিসেবে প্রাইভেট দেখবে না, বরং শুরুতেই প্রাইভেটে ভর্তি করাবে।
ঐ লম্বা আলাপ আজ থাক। আমি আসলে কিউরিয়াস মাহবুব স্যারের ব্যাপারটাতে। ওনার উপর রোর বাংলা আর্টিকেল পাবেন, সেটা পড়লে ওনার সম্পর্কে ভালো ধারণা পাবেন। ওইটা পড়ে নিয়েন। আপাতত না জানলে বলি, উনি খুবই অসাধারণ একজন শিক্ষক, মহামারির এই চরম সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা যাতে ব্যাহত না হয় তাই তিনি তার সহকর্মীদের সহায়তায় তৈরি করেন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম buX, যা কিনা দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথম। এমন বেশ কিছু প্রচেষ্টার ফলেই সীমিত ও ধীরগতির ইন্টারনেট সংযোগ নিয়েও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নির্বিঘ্নে তাদের কোর্সগুলো করতে পারছে। এক ছেলে বুয়েটে চান্স পেয়েও শুধুমাত্র স্যারের জন্য ব্র্যাকে ভর্তি হতে চেয়েছিল। এই মাহবুব স্যারকেই ব্র্যাক সরিয়ে দিতে চেয়েছে (সম্ভবত সরিয়েছেও, পরবর্তী আপডেট নেয়ার ইচ্ছা বা রুচি হয়নি)
ওয়েল, আমি সার্টেইনলি কিছু বলতে পারবো না, বাট ভালো সম্ভাবনা আছে, উনি সিনিয়র টিচার পলিটিক্সের শিকার।
আমার কিউরিওসিটি ঠিক এই জায়গায়। সিনিয়র টিচার, রাফলি যারা ইন্টারনেট-কম্পিউটার এভেইলেবল হওয়ার আগেই গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছেন এরাউন্ড ‘৮০-‘০০, যারা এখন প্রফেসর, তাদের কথা বলছি। এনাদের অনেক, এক্সপেরিয়েন্স আছে, এনারা অনেক শিক্ষিত, কিন্তু এনারা অনেক ক্ষেত্রেই কোনো প্রকার নতুন সিস্টেম মেনে নিতে রাজি না কেন? বিশেষত করোনার এই সময়ে আমরা দেখলাম, তাদের সদিচ্ছার প্রবল অভাব রয়েছে অনলাইন টিচিং এ।
কারণ এনারা মোটাদাগে এই ডিজিটাল দুনিয়ায় ইনকমপিট্যান্ট। আমি তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না। আমি শুধু গতো দশবছরে (আরও কমান, গতো ৫ বছরে) যে পরিবর্তন হয়েছে বিশ্বজুড়ে, এবং এর ফলে ফিজিকাল যা যা পরিবর্তন হয়েছে এবং শিক্ষার্থীদের যে মানসিক পরিবর্তন হয়েছে, সেইসব সম্পর্কে তারা জানে না, বোঝে না। এই ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে তারা ইনকমপিট্যান্ট, এই ডিভাইস ব্যবহারে তারা অপারগ। আর এই ইনকমপিট্যান্সি তৈরি করে ইনসিকিউরিটি। নতুন সিস্টেম নিয়ে ভেবে তারা তাদের পদ, সম্মান, ক্ষমতা নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ে এবং পুরনো সিস্টেমকে ছাড়তে চায় না, কোনো আপডেটে তারা আগ্রহী না।
ধরি, র প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নামের একটা বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেখানে পাস করার পর ১৫০+ সিগনেচার নেয়া লাগে ক্লিয়ারেন্স এর জন্য। এই ১৫০+ সিগনেচারে শিক্ষক থেকে শুরু করে ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা কর্মীরা পর্যন্ত আছেন। বোঝাই যাচ্ছে এটা যথেষ্ট যন্ত্রণাদায়ক একটা সিস্টেম। এই সিস্টেমের উপযোগিতা কি, প্রয়োজনীয়তা কি, সে সম্পর্কেও শিক্ষার্থীরা জানে না। তো সিন্ডিকেট মিটিং এ কিছু শিক্ষক এই নিয়মটা তুলে পুরোটা ডিজিটালাইজেশন করার কথা বললে অনেক সিনিয়র শিক্ষক এবং অফিস ক্লার্করাই এ নিয়মের পক্ষে। যুক্তি হচ্ছে, পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে দেখবে, সমস্যা কি? তাদের সময় তো ছিল, তারা পারলে এখন সমস্যা কি? সমস্যাটা তারা দেখেনা যে আগে ছিল সব সিরিজ মিলে হয়তো এক হাজার শিক্ষার্থী, আর এখন এক সিরিজেই এক হাজার শিক্ষার্থী।
এই যুক্তির মধ্যেই কিন্তু এইটা লুকায়ে আছে, কেন এই সিস্টেম পালটায় না। পুরোটা ডিজিটালাইজেশন হলে শিক্ষক এবং অফিস ক্লার্কদের প্রভাব খাটানোর এবং ক্ষমতা প্রদর্শনের একটা অস্ত্র কমে যাবে। স্টুডেন্ট যদি নিজে নিজেই সবটা করে ফেলতে পারে, তাহলে তাদের কেন দাম দেবে? হার্শ ট্রুথ ইজ, দামা কামাতে গিয়ে আর সম্মান কামানো হয় না।
দেখেন, দেশের ম্যাক্সিমাম পাবলিক ইউনিতে এখনও একটা ভালো অনলাইন সিস্টেম তৈরি হয়নাই। কিন্তু এই সময়টা কি উত্তম সময় ছিল না এটা তৈরি করার? শুধু করোনাই না, অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রেই এই সিস্টেম থাকাটা শিক্ষাব্যবস্থার জন্য ভালো। কিন্তু হয়নি। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কি এতোটাই আনপ্রোডাক্টিভ এবং অথর্ব দালানকোঠা যে তারা এমন কোনো শিক্ষক-শিক্ষার্থী উৎপাদন করতে পারেনি যে অনলাইনে ক্লাস-এক্সাম নেয়ার একটা ভালো মডিউল দাঁড় করাতে পারবেন? যদি পারেন, তাহলে দাঁড়ায়নি কেন? প্লিজ এটা বলবেন না শিক্ষার্থীরা চায়নি। শিক্ষার্থীরা অফলাইনেও অনেক কিছু চায়-চায়নি, সেসবের অনেক কিছুই লেজিট, কিন্তু সেসব কখনোই পূরণ করা হয়নি। তাই শিক্ষার্থীরা চায়নি, এজন্য অনলাইন ক্লাস এক্সাম হয়নি- এটা বুলশিট আলাপ।
অনলাইন ক্লাস-এক্সামের সাথে ইনকমপিটেন্সির যোগ কোথায়? সিনিয়র টিচাররা বা সিন্ডিকেট মেম্বাররা হয়তো জুমে বসে ক্লাস নেবেন বা বানানো মডিউলে এক্সামও নেবেন, কিন্তু সেই মডিউল তো তারা বানাচ্ছেন না। তাদের বানানোর সম্ভাবনাও কম। কারণ ডিজিটাল এই আপগ্রেডেশন সম্পর্কে তাদের ধারণা কম। যে সিস্টেম তারা দাঁড় করাতে পারেননি, সে সিস্টেম কার্যত তাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নাও থাকতে পারে। তারা কেন সেখানে ক্লাস এক্সাম নেবেন? আর ওয়ার্ক ফ্রম হোম বা ওয়ার্ক ফ্রম স্টাডি আগের তুলনায় বেশি হার্ড এবং মেন্টালি স্ট্রেসফুল (আমার কাছে মনে হয়েছে, কোনো ডেটা নেই)। কারণ আগে ওই এনভায়রনমেন্টেই আমরা থাকতাম, পাশে বন্ধু থাকতো, ক্লাসের ফাঁকে তাফালিং মেরে টাইম পাস হতো। এখন হয়না। আগে ক্লাস হতো ৫০ মিনিট একটা। আরেকজন আসার ফাঁকে ৪-৫ মিনিট এদিক ওদিক হতো। এখন ক্লাস নেয়া হয় (প্রায় প্রতিটি ইউনিতে, যে কদিন ক্লাস হয়েছে) দেড় ঘন্টা টানা। এখন অনলাইন ক্লাস যতো বেশি চলবে ততোবেশি এটা প্রমাণ হবে যে দে আর নট কমপিট্যান্ট ফর দিস সিস্টেম। তারা এফিশিয়েন্টভাবে ক্লাস নিতে পারবে না। বা এক্সামের সময় তারা সবকিছু নিজের কন্ট্রোলে রাখতে পারবে না যেটা অফলাইনে পারতো, খাতা কেড়ে নেয়া সম্ভব হবে না। এইগুলা তাদের ইনসিকিউর করে।
এই দেশে কিন্তু বাইরে থেকে হায়ার স্টাডিজ কমপ্লিট করে ভালো রেজাল্ট করে আসলেও আপনি পাবলিক ইউনি এর টিচার হতে পারবেন না। বড়জোর প্রাইভেটের টিচার হতে পারবেন। পাবলিক ইউনিতে কেবল পাবলিক ইউনির স্টুডেন্ট, কখনও ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীই শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয় শুধুমাত্র ক্লাস পজিশনের উপর ভিত্তি করে। আগেও এটা হয়েছে, এখনও এটা হচ্ছে। একজন বিএসসি কমপ্লিট করা মানুষকে ওভার ইভ্যালুয়েট করা হচ্ছে একজন ডক্টরেট করা মানুষের চেয়ে কেবল মাত্র *পাবলিক* *ক্যাম্পাস* এর *লিগ্যাসি* থেকে। আই উইল নেভার গেট দিস জোক!
কারণ, এই *লিগ্যাসি* মেইনটেইন না করলে মাহবুব মজুমদারদের মতো কেউ টিচার হলে, ডীন হলে এমন কিছু করতে পারে যেখানে সিনিয়র টিচারদের ইনকমপিটেন্সি বেরিয়ে আসবে। তাদের ক্ষমতা ইনিসিকিউর হয়ে পড়বে। নতুনদের মাঝে তারা খাবি খেতে পারে। স্টুডেন্টরা তাদের কাছে বারবার এসে নড করবে না তাহলে৷ এই যে সিগনেচার নেয়ার নিয়ম উঠে গেলে তো বারবার ঘুরঘুর করবে না অফিসে অফিসে, অনলাইনে এক্সাম নিয়ে ফেললে সিজি কমিয়ে শাস্তি দেয়ার সুযোগটা কমে আসতে পারে, কারণ পিডিএফ থাকবে প্রমাণস্বরুপ কে কি লিখেছে- এই সমস্যাগুলো স্বভাবতই কেউ ফেস করতে চাইবে না। কেউই এক্সিস্টিং সিস্টেম— যে সিস্টেম তার অদক্ষতাকে কেউ প্রশ্ন করে না, কোনো সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় না— সেই সিস্টেমকে পাল্টাইতে চাইবে না। যারা পাল্টাইতে চায় তাদেরও সহ্য করবে না।
এই শিক্ষাব্যবস্থাকে কিভাবে পাল্টাইতে পারেন, আমার ধারণাগুলো আমি বলবো না। আমার খুবই খারাপ একটা আশা আছে, গালি দিলে দেন, পাবলিক ইউনিভার্সিটি কলাপ্স করবে এবং এই কলাপ্স হওয়াটা আমি দেখতে চাই। এই যে ক্যাম্পাসের সমস্যা নাকি পাবলিক প্রোফাইলে দেয়া যাবে না, কোনো সমালোচনা করা যাবেনা কেবল মাত্র *চান্স পেয়ে দেখিয়েছি* এই শো-অফ আর ইন্সটিটিউশনাল প্রাইড দেখাতে হবে, এই পর্দাগুলা যেইদিন ছাই হয়ে যাবে সেইদিনটা দেখতে চাই। অলরেডি অনেকেই দেখা শুরু করেছে, কিন্তু এখনও যে ইন্সটিটিউশনাল প্রাইড থাকায় কিছু বলছে না (এমনই ইন্সটিটিউটের জন্য প্রাইড তাদের যারা এই একবছরে শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞাসাও করেনাই তোমাদের কোথায় সমস্যা হচ্ছে) সেই প্রাইডটুকুও একদিন শেষ হবে, পাবলিক-প্রাইভেটের এই নোংরা কাদা ছোড়াছুড়ি বন্ধ হবে, পাবলিকে চান্স না পাওয়ায় সুইসাইড বন্ধ হবে, প্রাইভেট থেকে পড়া স্টুডেন্ট ভালো রেজাল্ট দেখিয়ে এক্সাম দিয়ে পাবলিকের টিচার হবে, পুরনো অথর্ব নিয়ম ছুড়ে ফেলে আপগ্রেড করবে, নির্দিষ্ট সময় পরপর টিচারদের ইভালুয়েশন হবে, যে সেক্টরে পিছায়ে আছে বা নতুন যা পাঠদানের জন্য তাদের শেখা দরকার সেই ট্রেনিংটা তারা নেবে— সেদিন হয়তো এই শিক্ষা ব্যবস্থা একটু মাজা তুলে দাঁড়াবে বলে বিশ্বাস। আর এর পুরোটা হওয়ার আগে বোধহয় ওই কলাপ্স করাটা জরুরি। আমরা তো আবার দেখে শিখি না, ঠেকেই শিখি।