মাতাহারি কি সত্যি একজন জার্মানি গুপ্তচর ছিলেন?
১৫ই অক্টোবর ১৯১৭ সাল। তখন শেষ রাতের ঘণ্টা বাজছিল দূরের ঘড়িঘরে। ফ্রান্সের কুখ্যাত জেলের নোংরা আর দুর্গন্ধ ১৭ নম্বর সেলে দু’জন সন্ন্যাসিনীকে নিয়ে এসে পৌঁছেছিলেন কর্তব্যরত অফিসার। ভারী বুটের শব্দে চমকে ঘুম ভেঙে উঠে বসেছিলেন সেলের সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী। তাঁর চোখেমুখে তখনও লেগে ছিল অবিশ্বাসের ঘোর। ‘‘অসম্ভব, এ অসম্ভব!’’ বলেও মুহূর্তে নিজেকে সংযত করে, পোশাক পালটে, একঢাল কালো চুল তিনি ঢেকে নিয়েছিলেন তিনকোনা টুপিতে। তারপরে সন্ন্যাসিনীদের বলেছিলেন, ‘‘আমি প্রস্তুত।’’ এরপরে প্যারিসের শুনশান রাজপথ দিয়ে ছুটে চলেছিল একটা গাড়ি। একটা সময়ে সেই শহর কী দেয়নি তাঁকে! তাঁকে দিয়েছিল নাম, যশ, অর্থ, স্তাবক। তাঁর স্বপ্নের শহর ছিল প্যারিস। যথাস্থানে পৌঁছে গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে তাঁর পা কেঁপে গিয়েছিল একটু। ওদিকে বধ্যভূমি প্রস্তুত ছিল। ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি চোখ ঢাকতে রাজি হননি। তিনি মৃত্যুর চোখে চোখ রাখতে চেয়েছিলেন। তাঁর বুকের দিকে বন্দুক তাক করা অফিসারের দিকে শান্ত ভাবে তাকাতেই তাঁকে লক্ষ্য করে ছুটে এসেছিল গুলি। নতজানু হয়ে বসে পড়েছিলেন তিনি। কি আশ্চর্য! তাঁর মুখের একটা রেখাও কাঁপে নি, শুধু মাথাটা হেলে গিয়েছিল পিছনের দিকে। তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করতে কপালের ঠিক মাঝখানে আর একটা গুলি করেছিলেন দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার। কাজ শেষ করে স্বগতোক্তি করেছিলেন তিনি, ‘‘এ মেয়ে জানে, কী ভাবে মরতে হয়।’’
পরের দিন ফরাসি খবরের কাগজগুলির প্রথম পাতায় ফলাও করে ছাপা হয়েছিল তাঁর মৃত্যুসংবাদ। একটি সংবাদপত্র তাঁর সম্বন্ধে লিখেছিল, ‘‘আমাদের দেশের আতিথেয়তাকে দিনের পর দিন ব্যবহার করে, শেষে আমাদের সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা! উপযুক্ত শাস্তি পেল মাতা হারি।’’ কেউ আবার লিখেছিল, সামরিক আদালতে নিজের ঘৃণ্য অপরাধের কথা স্বীকার করেছিলেন তিনি। সবাই জেনেছিলেন, মোহিনী, লাস্যময়ী ‘মাতা হারি’ আসলে ছিলেন ‘জার্মানির গুপ্তচর’। যাঁর বিশ্বাসঘাতকতায় হাজার হাজার ফরাসি সৈন্য যুদ্ধে মারা গিয়েছিলেন। কুখ্যাত ‘ডাব্ল এজেন্ট’ মাতা হারির মৃত্যুর পিছনে যে কী ইতিহাস লুকিয়ে, সেটা কেউ জানতে পারেননি। কেউ জানতে চানও নি।
মাতা হারির আসল নাম ছিল ‘মার্গারেটা গের্ট্রুডা জেল’। ১৮৭৬ সালের ৭ই অগস্ট ‘নেদারল্যান্ডসে’ তাঁর জন্ম হয়েছিল। ধনী বাবার আদরে বড় হওয়া মেয়েটা ছোটবেলা থেকেই বিলাসে অভ্যস্ত ছিল। হঠাৎ বিপর্যয় নেমে এসেছিল তাঁদের পরিবারে। হঠাৎ তাঁর মা মারা গিয়েছিলেন। নিরাপত্তাহীন বিপর্যস্ত জীবনে যখন তাঁর প্রায় দমবন্ধ অবস্থা, তখনই খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনে সাড়া দিয়ে তাঁর চেয়ে বয়সে প্রায় দ্বিগুণ ‘ক্যাপ্টেন রুডল্ফ ম্যাকলেওড’কে বিয়ে করে ফেলেছিলেন বছর বাইশের সেই মেয়ে। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে তিনি চলে গিয়েছিলেন ‘ইন্দোনেশিয়া’। সেখানে পর পর তাঁর দুই সন্তানের জন্ম হয়েছিল। দুর্ভাগ্য অবশ্য সেখানেও তাঁর পিছু ছাড়ে নি। তাঁর স্বামীরত্নটি শুধু মদ্যপ আর অত্যাচারীই ছিলেন না, সাথে যৌনরোগগ্রস্ত ছিলেন। তাঁর আবার একটি বাঁধা রক্ষিতাও ছিল। এক জন পুরুষের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা কোনও দিন তাতে ছিল না ‘মার্গারেটা’র, তার উপর এ হেন স্বামী। তাই একের পর এক সামরিক অফিসারের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে শুরু করেছিলেন ‘মার্গারেটা’। এরই মধ্যে তাঁর দুই সন্তান ভয়ংকর অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। মেয়েকে কোনও ক্রমে বাঁচানো গেলেও, ছেলেটি মারা গিয়েছিল। দুই সন্তানই বাবার কাছ থেকে পেয়েছিল ‘সিফিলিস’। তাই সেই অসুখী দাম্পত্য আর টিকিয়ে রাখা যায়নি। মেয়েকে নিজের কাছে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেও অর্থাভাবে সফল হতে পারেননি ‘মার্গারেটা’।
️
কপর্দকশূন্য ‘মার্গারেটা’ ১৯০৩ সালে এসেছিলেন প্যারিসে। কিছু দিন সার্কাসে কাজ করার পরে তিনি নাচের দুনিয়ায় পা রেখেছিলেন। ইন্দোনেশিয়ায় থাকার সময় সেখানকার নৃত্যশৈলী শিখেছিলেন তিনি, সে বার সেটা কাজে লাগাতে গল্প বানিয়েছিলেন তিনি। সকলকে তিনি জানিয়েছিলেন, তিনি আসলে জাভার রাজকুমারী, প্রাচ্যের সভ্যতা-সংস্কৃতি সব তাঁর আয়ত্ত। এর আগেই তিনি নিজের নাম নিয়েছিলেন ‘মাতা হারি’। স্টেজে সেই নামই ব্যবহার করতে শুরু করেছিলেন। তাঁর জলপাই-রং ত্বক, কালো চোখ, একঢাল কালো চুল, শরীরী আবেদনে মাতাল হয়ে গিয়েছিল প্যারিস। মাতা হারি জানতেন, প্রচারের সব আলো কী ভাবে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিতে হয়। পাতলা ওড়না শরীরে জড়িয়ে মঞ্চে আসতেন, নাচতে নাচতে ছুঁড়ে দিতেন সেটাও। নগ্নতাকে তিনি শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। ইরোটিক নাচের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিলেন মিথ, আধ্যাত্মিকতাও।
এরপরে আর অর্থের অভাব হয়নি তাঁর। পাল্লা দিয়ে বেড়েছিল তাঁর বিলাসব্যসন, আড়ম্বরের খরচ। ১৯১০ সালের মধ্যে সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর নাম। তবে বেশি দিন এ ভাবে চালাতে পারেননি তিনি। নর্তকী হিসাবে তাঁর জনপ্রিয়তায় যত ভাটা পড়তে শুরু হয়েছিল, ততই পুরুষ সঙ্গীর ওপর নির্ভরশীল হতে শুরু করেছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত শরীর ও সাহচর্যের বিনিময়ে রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্সের উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার আর ধনী পুরুষদের কাছ থেকে অর্থ উপার্জন করতে করেছিলেন ‘মাতা হারি’। এর সাথে তাঁর সঙ্গী হয়েছিল কেচ্ছা, দুর্নাম। তবে তাতেও তাঁর কোন পরোয়া ছিল না। কিন্তু তাঁর সমস্ত হিসেবনিকেশ উলটপালট করে দিয়েছিল ১৯১৪ সালে শুরু হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নেদারল্যান্ডস নিরপেক্ষ থাকায় স্বাধীন ডাচ নাগরিক হিসাবে ইউরোপের সব জায়গায় যাতায়াত করতে পারতেন ‘মাতা হারি’। সেই সময় একটা শো করতে জার্মানি গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বার্লিনে তাঁকে আটকে দেওয়া হয়েছিল। তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সিজ করে, টাকাপয়সা-গয়না সব আটকে দিয়েছিলেন জার্মান অফিসাররা। তাই সফর অসমাপ্ত রেখেই ফিরে যেতে হয়েছিল ‘মাতা হারি’কে। সেই সময়েই তাঁর পরিচয় হয়েছিল ‘কার্ল ক্রোমার’ নামে এক জার্মান কনসালের সঙ্গে। তিনি মাতা হারিকে জার্মানির হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির প্রস্তাব দিয়েছিলেন, আর সাথে দিয়েছিলেন ২০,০০০ ফ্রাঁ-ও। সেই সঙ্গে দিয়েছিলেন তাঁর একটা ‘কোড নেম’, ‘H-21’। বিলাসে ভাসা ‘মাতা হারি’র অর্থের ব্যাপারে কোন বাছবিচার ছিল না। তিনি অনায়াসে সেই টাকা নিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, তাঁর যে জিনিসপত্র আর টাকা জার্মানি আটক করেছে, তার বদলে সেই অর্থ তাঁর প্রাপ্য। গুপ্তচর হওয়ার কোনও অভিপ্রায় তাঁর ছিল না। ব্রিটেন হয়ে ফ্রান্সে ফেরার সময় ব্রিটিশ গোয়েন্দারা তাঁকে আটক করে তল্লাশি করেছিল, কিন্তু সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায়নি। ফ্রান্সে ফিরে যথারীতি বিলাসে ডুবে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু জানতেও পারেননি যে, তিনি পুলিশের নজরবন্দি হয়ে পড়েছেন।
ইতিমধ্যে তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো একটা ঘটনা ঘটেছিল। প্রেমে পড়েছিলেন ‘মাতা হারি’, জীবনে প্রথম বার। প্রেমিক ছিলেন রাশিয়ান পাইলট ‘ভাদিম মাসলভ’। তিনি তাঁর সঙ্গে বারবার দেখা করতে শুরু করেছিলেন রাশিয়ার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে। মাসলভ যুদ্ধক্ষেত্রে গুরুতর আহত হয়েছিলেন, আহত প্রেমিকের পাশে পৌঁছতে মরিয়া ‘মাতা হারি’ দেখা করেছিলেন ফ্রান্সের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার এক অফিসারের সঙ্গে। সেই অফিসার তাঁকে জানিয়েছিলেন, যাওয়ার অনুমতি মিলবে, তবে ফ্রান্সের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির শর্তে। নিরুপায় হয়ে ‘মাতা হারি’ সেই শর্তে রাজি হয়েছিলেন। বিনিময়ে চেয়েছিলেন ১০ লক্ষ ফ্রাঁ। ভেবেছিলেন, প্রেমিক সুস্থ হলে সেই টাকা দিয়ে নতুন জীবন শুরু করবেন দু’জনে।
হল্যান্ডে ‘মিশন’-এ যাওয়ার পথে স্পেনে আটকে দেওয়া হয়েছিল ‘মাতা হারি’কে। সেখানেও এক জার্মান গোয়েন্দাকর্তাকে রূপ আর যৌনতার অপ্রতিরোধ্য টোপ দিয়ে উত্তর আফ্রিকায় জার্মান রণকৌশল সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নিয়েছিলেন তিনি। বিনিময়ে তাঁকে ফ্রান্সের কিছু গুরুত্বপূর্ণ খবর দেওয়ার ভান করেছিলেন। ‘মিশন’-এর সাফল্যের খবর যথাস্থানে দিয়ে ভেবেছিলেন, দাবি মতো তাঁর টাকাটা এ বার পেয়ে যাবেন। অন্য দিকে সেই জার্মান গোয়েন্দাকর্তাটি বার্লিনে এক রেডিয়ো-বার্তা পাঠিয়েছিলেন, জার্মান গুপ্তচর ‘H-21’ তাঁকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। ইচ্ছে করে তিনি এমন কোডে বার্তাটি পাঠিয়েছিলেন, যে কোডের অর্থ অনেক আগেই ফ্রান্স উদ্ধার করে ফেলেছিল। তাই অবধারিত ভাবে বার্তাটি ফ্রান্সের হাতে এসে পড়েছিল। বর্ণনার সঙ্গে মিলিয়ে ফরাসি কর্তারা বুঝতে পেরেছিলেন, ‘H-21’ আসলে আর কেউ নয়, ‘মাতা হারি’।
১৯১৭ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি প্যারিসের এক হোটেল থেকে ‘মাতা হারি’কে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তদন্তকারী ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কুখ্যাত ‘সঁ লাজার’ জেলে। দিনের পর দিন জেরা চলেছিল। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য নানা জায়গায় অজস্র চিঠি লিখেছিলেন ‘মাতা হারি’। তাতে কোনও কাজ হয়নি। ফ্রান্স খুব ভালমত জানত, ‘মাতা হারি’র বিরুদ্ধে তাঁদের হাতে সেই জার্মান গোয়েন্দাকর্তার পাঠানো রেডিয়ো-বার্তা ছাড়া আর কোনও তথ্য-প্রমাণ নেই। তাই বিচার চলাকালীন ‘মাতা হারি’র উকিলকে না করতে দেওয়া হয়েছিল জেরা, না কোনও সওয়াল। ‘মাতা হারি’ তত দিন যেখান থেকে যত টাকা পেয়েছিলেন – হোক তা জার্মান আধিকারিকদের সঙ্গ দেওয়ার বিনিময়ে, বা এক ডাচ ব্যারনের কাছ থেকে মাসোহারা বাবদ – সেটার সবটাই গুপ্তচরবৃত্তির জন্য ‘জার্মানির কাছ থেকে পাওয়া টাকা’ বলে প্রমাণ করা হয়েছিল। এরই মধ্যে ‘মাতা হারি’ ‘কার্ল ক্রোমার’ নামের সেই জার্মান কনসালের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কথা স্বীকারও করেছিলেন। এতে আরও মজবুত অজুহাত পেয়ে গিয়েছিল ফ্রান্স। দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন ‘মাতা হারি’। শেষে ১৯১৭ সালের ১৫ই অক্টোবর তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল।
সুন্দরী। অপ্রতিরোধ্য যৌন আকর্ষণের অধিকারী। বিশ্বাসঘাতক। পৃথিবীর অন্যতম সেরা গুপ্তচর। এত সব কিছু মিলিয়ে যে ছবিটা আঁকা হল, তার তলায় ঢাকা পড়ে গেল ‘মাতা হারি’র অন্য মুখ। আদৌ কী গুপ্তচর ছিলেন তিনি? বিতর্ক কম নেই সেই নিয়ে। কিন্তু তদন্তকারী ম্যাজিস্ট্রেট যেমন বলেছিলেন, ‘‘দ্য গ্রেটেস্ট ওম্যান স্পাই অফ দ্য সেঞ্চুরি’’, তিনি তা ছিলেন না। ‘ডাব্ল এজেন্ট’ তো ছিলেনই না। ‘মাতা হারি’ তাঁর বিচার চলাকালীন বারবার বলে গিয়েছিলেন, তাঁর বিশ্বস্ততা শুধুমাত্র ফ্রান্সের প্রতি। হয়তো মিথ্যেও ছিল না সেই দাবি। কিন্তু তাঁর কথায় কেউ কর্ণপাত করেনি। করার দরকার মনে করেনি, কারণ সেটাই তো তাঁরা চেয়েছিলেন।
যুদ্ধের প্রবল খিদের সামনে সেই সময় একটা বলি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল। যখন একসঙ্গে ফ্রান্স আর জার্মানির উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার আর গোয়েন্দা দফতরের অধিকর্তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছিলেন তিনি, তখন ঘটনাচক্রে ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে যুদ্ধে কৌশলগত ভুলের জন্য জার্মানির কাছে প্রবল ধাক্কা খাচ্ছিল ফ্রান্স। প্রচুর সৈন্য মারা গিয়েছিল যুদ্ধে। ১৯১৭ সালে রণক্লান্ত ফ্রান্সের সৈন্যরা বিদ্রোহ করেছিলেন। সেই অবস্থায় বিদ্রোহী, হতোদ্যম সৈন্যদের মনোবল ফিরিয়ে এনে হারতে-বসা যুদ্ধটা জেতার জন্য এক জন ‘বিশ্বাসযোগ্য বিশ্বাসঘাতক’ তৈরি করার দরকার ছিল। ঠিক এই কারণেই হারের দায়ভার চাপানো হয়েছিল ‘মাতা হারি’র ওপর। এর চেয়ে আদর্শ বলি আর কে-ই বা হতে পারতেন! যে মেয়ে নগ্নতায় নির্লজ্জ, যাঁর পুরুষসঙ্গী গুনে শেষ করা যায় না, অর্থের লোভে যে সবার শয্যাসঙ্গী হতে পারে, সেই মেয়ে গুপ্তচর হবে না তো কী হবে? নিপুণ হাতে তাঁর বিরুদ্ধে ফাঁদ পেতেছিল জার্মানি আর ফ্রান্স। আর রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ‘মাতা হারি’ বোকার মতো সেই ফাঁদে পা দিয়েছিলেন।
আরও একটা বড় কারণ ছিল – সেই সময় জার্মানির আসল গুপ্তচর, যাঁরা ফ্রান্সে কাজ করছিল, তাঁদের থেকে নজর ঘুরিয়ে ফ্রান্সকে বিভ্রান্ত করা। রাজনীতি, ক্ষমতালিপ্সা আর যুদ্ধ মেশানো এত জটিল খেলা ‘মাতা হারি’ বুঝতে পারেননি। সমাজকেও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ববর্তী সমাজের পক্ষেও ‘মাতা হারি’কে মেনে নেওয়া কঠিন ছিল। যে সমাজে তার কিছু দিন আগেও ‘বাড়াবাড়ি’ না করে স্ত্রীকে মারধর করা বৈধ ছিল, যেখানে ‘বিবাহবিচ্ছিন্না নারী’ মানে ব্যবহার করে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া মেয়েমানুষ, সেই সমাজ আর সময়ের থেকে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন তিনি। ব্রিটেনে তাঁকে আটক করা হয়েছিল কিসের ভিত্তিতে? না, ‘‘যে মেয়ে এমন সুন্দরী, যে এতগুলি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে, যে মেয়ে কোনও পুরুষসঙ্গী ছাড়াই একা ইউরোপ ঘুরে বেড়ানোর ক্ষমতা রাখে, তাঁকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখা যায় না।’’ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অজস্র পুরুষ এবং দশ জনেরও বেশি মহিলাকে গুপ্তচর সন্দেহে ধরা হয়েছিল। এঁদের মধ্যে সব থেকে চর্চিত তিনি, ‘মাতা হারি’।
️
অথচ ‘খারাপ মেয়েমানুষ’ তকমার আড়ালে যে প্রেমিকা, যে মা লুকিয়ে রইল, তাঁকে কেউ দেখল না। জীবনে প্রথম বার ফ্রান্সের হয়ে যে গুপ্তচরবৃত্তি তিনি করার চেষ্টা করেছিলেন, সেটা শুধুই নিজের প্রেমকে বাঁচানোর জন্য। অজস্র পুরুষকে বিছানায় সঙ্গ দিয়ে খুব সম্ভবতঃ তিনি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তাই চল্লিশ বছর বয়সে থিতু হতে চেয়েছিলেন জীবনে।
কিন্তু তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। প্রেমিক ‘ভাদিম মাসলভ’ তাঁর ঘোর দুঃসময়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। ‘মাতা হারি’ গ্রেফতার হওয়ার পর তিনি সাফ বলে দিয়েছিলেন, তাঁদের দু’জনের ভালবাসার সম্পর্কের কোনও মূল্যই আর নেই তাঁর কাছে। এতটা প্রবঞ্চনা আশা করেননি ‘মাতা হারি’। খবরটা শুনে তিনি কোর্ট রুমে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন।
সন্তানকে কাছে না পাওয়ার যন্ত্রণাও নিরন্তর তাড়া করেছিল তাঁকে। এক সময় অর্থের অভাবে মেয়েকে কাছে রাখতে পারেননি। পরে যখনই সেই চেষ্টা করেছিলেন, তাঁর নগ্ন ছবি, চরিত্রের দুর্নাম তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিলেন তাঁর স্বামী। বলেছিলেন, পতিতা কোনও দিন ভাল মা হতে পারে না। মেয়েকে অজস্র চিঠি লিখেছিলেন ‘মাতা হারি’। সব ফেরত এসেছিল। এমনকী মরিয়া মা নিজের মেয়েকে স্কুল থেকে অপহরণ করার চেষ্টাও করেছিলেন। বলা বাহুল্য, সফল হননি। মৃত্যুর আগে ‘মাসলভ’ আর নিজের মেয়েকে চিঠি লিখেছিলেন ‘মাতা হারি’। জেল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছিলেন, তাঁর জীবনের শেষ ইচ্ছা, সেই চিঠি দু’টো যেন যথাস্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। হয়নি। ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল সেই চিঠি দু’টো।
‘মাতা হারি’ কী ছিলেন আর কী ছিলেন না, তা নিয়ে তাঁর মৃত্যুর একশো বছর পরও বিতর্ক আর গল্পের শেষ নেই। তাঁর ব্যবহৃত জিনিস এখনও অবিশ্বাস্য দামে নিলামে ওঠে। বহু-আলোচিত এই চরিত্র জন্ম দিয়েছে অজস্র বই আর চলচ্চিত্রের। সৌন্দর্যের খ্যাতি আর চরিত্রের কুখ্যাতি নিয়ে ‘মাতা হারি’ এক কিংবদন্তী। আর কে না জানে, কিংবদন্তীর মৃত্যু হয়না!
বি:দ্র: সকল তথ্য google থেকে নেওয়া হয়েছে।